মামুনুর রশিদ ::
জীবন সায়াহ্নে এসেও অকুতোভয় মুক্তিযোদ্বার স্বীকৃতি পাননি মুক্তিসেনা দাইমদ্দিন হাওলাদার। কেউ খোজ রাখেনি বলে মেলেনি রাষ্টীয় স্বীকৃতি। জীবন গাড়ির চাকার পড়ন্তবেলায় তিনি আজ নিঃস্ব ও অসহায়! ফেলে আসা অতীত আর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বুকে ধারণ করে অভাব অনটনের মাঝে চিকিৎসাবিহীন ভঙ্গুর “মানবেতর জীবনযাপন” পার করছেন।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আজ শুধু একটি চাওয়া! মৃত্যুর আগে তিনি যেন স্বীকৃতি পান একজন মুক্তিযোদ্বার।
ছায়াশীতল মাখা গ্রামটির নাম উত্তর কালামৃধা। ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার কালামৃধা ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী উত্তর কালামৃধা গ্রামের দাইমদ্দিন হাওলাদারের ছেলে মাইনুদ্দিন হাওলাদার (৭২)। জন্ম ৩ আগষ্ট ১৯৪৭। বয়স প্রায় আশি ছুই ছুই করছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশমাতৃকার টানে এই বীর সেনানী নিজের জীবন বাজি রেখে ঝাপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্বে।
মুক্তিকামী মাইনুদ্দিন হাওলাদার দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের বীরভুমে গিয়ে সামরিক প্রশিক্ষন গ্রহন করেন। যুদ্বের প্রশিক্ষনের পর জেনারেল এমএ জি ওসমানীর নিকট থেকে হাতে পান প্রশিক্ষন সনদ ।
দেশে ফিরে পাকহানাদারদের বিরুদ্বে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়তে থাকেন। রনাঙ্গনে যুদ্ব শেষে বীরের বেশে ফিরে এসে তৎকালীন সময়ে ফরিদপুরের টেকনিক্যাল কলেজে অস্ত্রও জমা দেন । অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছরে মুক্তিযোদ্বার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়নি এই বীর সেনানীর নাম। পাননি কোন রাষ্টীয় স্বীকৃতি। পরাক্রমশালী পাকবাহিনীকে যুদ্বে পরাজিত করলেও জীবনযুদ্বে আজ পরাজিত জাতির এই শ্রেষ্ট সন্তান।
সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই দামাল ছেলেদের দলের সদস্য মাইনুদ্দিন হাওলাদার ছায়ামাখা সুশীতল পরিবশে একটি পাঠকাঠীর ছাওনি দিয়ে ঘেরা কুঁড়ে ঘরে বসবাস করছে। একমুঠো ভাত যোগাড় করতে চরম যুদ্ধ করতে হচ্ছে। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি আজ শয্যাশায়ী হয়ে। অর্থঅভাবে সুচিকিৎসার করতে না পেরে বিছানায় শুয়ে গুমরে গুমরে কাটছে যার দিন। মুক্তিসেনা দাইমদ্দিন হাওলাদারের একটি ছেলে স্থানীয় বাজারে চায়ের দোকান করেন। অন্য একজন রং মিস্ত্রি। অভাব অনটনের ঘানি নিয়ে কাটছে পরিবারের দিনগুলি। সেই দৃশ্য দেখে বিবেকবান যে কোন মানুষের বিবেক নাড়া দেয়!
এ প্রতিবেদকের কাছে আক্ষেপ করে মাইনুদ্দিন হাওলাদার বলেন, বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অসহায় মুক্তিযোদ্বাদের জন্য আজ অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন। জীবনের শেষ বেলায় আমার একটি চাওয়াটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে! রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিয়ে যেন জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারি। যে কটি দিন বেঁচে আছি, আমার সুচিকিৎসার আর্থিক সাহায্যে জন্য তিনি এগিয়ে আসেন।
প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তার। কথা বলার ফাকে তার দু,চোখ অশ্রুজলে ভরে উঠে। মনের অজান্তে গুমরে গুমরে কেঁদে উঠেন অসহায় মুক্তিযোদ্বা মাইনুদ্দিন হাওলাদার।
মাইনুদ্দিন হাওলাদারের পুত্র মুকুল হাওলাদার। তিনি পেশায় একজন চায়ের দোকানদার। নিজের পিতার প্রসঙ্গে বলেন, আমার বাবা দেশকে ভালবেসে যুদ্ব করে দেশ স্বাধীন করেছেন। অথচ শেষ বয়সে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে চলে যেতে হবে। একথা বলতে গিয়ে তিনি আবেগ আপ্লূত হয়ে পড়েন।
তিনি আরও বলেন, নিজের সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। সেই সাথে বাবার চিকিৎসার খরচ। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অসহায় একজন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের দাবী, আমার পিতার সুচিকিৎসার জন্য সাহায্য প্রাথনা করছি।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্বা শফিউদ্দিন বাবু বলেন, একজন মুক্তিযোদ্বা স্বীকৃতি না পেয়ে দুনিয়া বিদায় নিবে এটা আমাদের কাম্য নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অসহায় এই মুক্তিযোদ্ধার সাহায্যের জন্য আমি জোড় দাবী জানাই।
কালামৃধা ইউপি চেয়ারম্যান লিটন মাতুব্বর বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের কাছে আমার দাবী মাইনুদ্দিন হাওলাদারের শেষ জীবনের ইচ্ছের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে একটি সঠিক তদন্তের মধ্যে দিয়ে মুক্তিযোদ্বার তালিকায় অন্তভুক্ত করতে তারা সচেষ্ট হন।
ভাঙ্গা উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্বা কমান্ডার আমিনুল ইসলাম বলেন, নিভৃত পল্লীতে একজন মুক্তিযোদ্বা যিনি অত্যান্ত অসহায়ভাবে দিন অতিবাহিত করছে শুনে আমি মর্মাহত। তার সুচিকিৎসার পাশাপাশি আমরা তাকে মুক্তিযোদ্বার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার জন্য উর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের নিকট আবেদন জানাব।
ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুকতাদিরুল আহমেদ বলেন, বিষযটি আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারলাম। আমি এখানে আসার পূর্বেই মুক্তিযোদ্বা যাচাই বাছাই কার্যক্রম সমাপ্ত হয়েছে। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
এলাকার সুধীমহল মহান মুক্তিযুদ্বে অংশগ্রহনকারী এই বীর সেনানীকে মুক্তিযোদ্বার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে রাষ্টীয় স্বীকৃতি দিয়ে অবিলম্বে তার চিকিৎসাসহ সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোড় দাবী জানিয়েছেন।